গণতন্ত্রে মিডিয়ার ভূমিকা এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রতিচ্ছবি?

Daily Inqilab স্টালিন সরকার

০৬ মে ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ০৬ মে ২০২৪, ১২:০৬ এএম

দেশে চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নদীর তলদেশে কর্ণফুলি ট্যানেল, রাজধানীতে অসংখ্য ফ্লাইওভার, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালে চোখ পড়লে মনে হয় দেশ বহুদূর এগিয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় খাবার কমিয়ে দিয়েছে। লেখাপড়ার শেষ করে কাজ না পেয়ে মেধাবী ছেলে-মেয়েরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলছে ডলার সংকট, আইএমএফের ঋণ নিয়েও সংকটের সুরাহা হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা বকেয়া থাকায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট কমিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ায় ব্যাংকিং সেক্টর খাদের কিনারে। গ্রাহকরা এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পায়। পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো; এখন ১৫ থেকে ২০টি পরিবার গোটা রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। জীবনযাত্রায় ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলেও মানুষের আয় তেমন বাড়েনি। বিদেশি ঋণে চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়নের যাঁতাকলে এতো গেলে মানুষের চিরেচ্যাবটা হয়ে যাওয়ার চিত্র। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের কি ভোটের অধিকার আছে? মত প্রকাশের স্বাধীনতা! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? গত ৪ মে রংপুরের এক সভায় সুশাসনের জন্য নাগিরকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গেছে। মানুষ সঙ্কটের মধ্যে আছে। গণতন্ত্র মানে সমন্বয়ের শাসন। আইনের শাসন হারিয়ে গেছে। নির্বাসনে যাওয়া গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিতে হবে রাজনীতিবিদদের।’ প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো কী সে দায়িত্ব পালন করছে? ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলো কোন পথে? গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই মাধ্যম কী ভূমিকা পালন করছে?

গত ২৭ এপ্রিল জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভায় দলটির চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা জিএম কাদেরের দেয়া একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ভাইরাল’। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগে রাজনৈতিক কোনো চরিত্র নেই। দেশের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এখন আওয়ামী লীগ। দলটি যা করছে সবকিছু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৭ জানুয়ারি বিদেশি তিন শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে।’ জিএম কাদেরের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘কোন বিদেশি শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে তা তাকে (জিএম কাদের) বলতে হবে’। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে নিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলতে গিয়ে নিজেরাই চাপে পড়েছে। জনগণ তাদের পাশে নেই। বিএনপি নেতারা ঝিমিয়ে পড়েছেন। কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।’ প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি কী সত্যিই চাপে পড়েছে, দলটির নেতারা হতাশ? টানা চার দফায় ক্ষমতায় আসায় আওয়ামী লীগ কী রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে?

প্রকৃত সত্য হচ্ছে দেশের রাজনীতিকদের কেউ আয়নায় নিজের চেহারা না দেখে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অভ্যস্ত। প্রবাদে রয়েছে ‘দেয়ালের দিকে তাকান, প্রকৃত চিত্র বুঝতে পারবেন’। সে দেয়ালের দিকেও কেউ তাকাচ্ছেন না। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ স্বাধীন সার্বভৌম দেশে গণতন্ত্র, জনগণের ভোটের অধিকার, আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়ার মানসিকতা সবকিছু ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ হয়ে গেছে। ২০১৪, ২০২৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণে প্রকৃত অর্থে ভোট দিতে পারেনি। দশম জাতীয় সংসদে ‘প্রার্থী ভোটার বিহীন নির্বাচন’, একাদশ জাতীয় সংসদে ‘রাতের নির্বাচন’ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ‘ভোট বর্জনের নির্বাচনে’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি সংসদে গেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটের একদিনের ‘রাজা’ জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এই বিতর্কিত নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতায় এসে ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ কার্যত রাজনৈতিক চরিত্র হারাতে বসেছে। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করে সাংবাদিকদের কাউকে ভয় দেখিয়ে, কাউকে আইনের ফাঁদে ফেলে, হামলা-মামলা দিয়ে, কাউকে পদ-পদবি, প্লট-ফ্লাট সুবিধা দিয়ে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রক করছে। একই সঙ্গে সরকার ও দলকে একাকার করে ফেলায় বিভিন্ন অঞ্চলে দলের মধ্যে ‘মনস্টার’ তৈরি করেছে। তারা এখন উপজেলা নির্বাচনে বিকট মূর্তি; দানবীয় চরিত্র এবং বিশাল প্রতিমূর্তি ধারণ করেছে। প্রশাসন, আইন শৃংখলা বাহিনীকে দলীয় বাহিনীর মতো ব্যবহার করায় দলের ভিতরেই এক ধরনের ফ্রাঙ্কেস্টাইন তৈরি হয়েছে। যারা ফ্রাঙ্কেস্টাইন তৈরি করেছেন; ওই ফ্রাঙ্কেস্টাইন এখন দানব রুপে মণিবকে চোখ রাঙ্গাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়-স্বজনদের ‘নির্বাচনে প্রার্থী হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া’র কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে ক্ষমতাসীন দলটিকে পিছু হটতে হয়েছে। বরং তারা বিভিন্ন অঞ্চলে এতোই শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বৈঠকে বিষয়টি উঠানোর সাহস করেননি। সুপারস্টার নামের মনস্টার ও মেগাস্টার নামের ফ্রাঙ্কেস্টাইনের ওপর ক্ষমতাসীন দলটি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে বিএনপির অবস্থা কেমন? অনেকেই বলেন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। উপজেলা নির্বাচন বর্জনের পরও তৃণমূলের কিছু নেতা প্রার্থী হওয়া ও তাদের দল থেকে বহিস্কার করার চিত্র এখন দৃশ্যমান। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রায় শতাধিক মাঠ পর্যায়ের নেতাকে বহিস্কার করেছে। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বিএনপির তৃণমূলের নেতাদের জার্মান গণমাধ্যম ডয়সে ভেলে ‘বিএনপির তৃণমূলের এসব নেতা শেখ হাসিনার আদর্শে অনুগত’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিএনপির এই নেতাদের কারো কারো এলাকায় প্রভাব থাকলে দলের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা কেন্দ্রের বহিস্কার সিদ্ধান্তে দারুণ খুশি। তারা বলছেন, এই সব নেতার বেশির ভাগই দীর্ঘ ১৭ বছর কেউ দল থেকে দূরে রয়েছেন, কেউ মামলা-হামলা থেকে রক্ষা পেতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছেন। ২০১৩ সালের পর দলটির যেসব নেতার বিরুদ্ধে শত শত মামলা, হামলা হয়েছে; হাজার হাজার নেতা কারাবরণ করেছেন সে তালিকায় এসব নেতার নাম নেই। এছাড়াও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের পৈসাচিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে, পুলিশী নির্যাতন এবং গ্রেফতার এড়াতে দিনে পালিয়ে থেকে রাতে জঙ্গলে ঘুমানো, মাঝ নদীতে নৌকায় ঘুমানো, ধানক্ষেতে মশারি টানিয়ে ঘুমানো হাজার হাজার নেতার তালিকায় নির্বাচনে অংশ নেয়াদের নাম নেই। শুধু তাই নয় ব্যবসা বাণিজ্য হারিয়ে, লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখে যারা এলাকা ছেড়ে দূর শহরে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে রিক্সা চালিয়ে, সিএনজি অটো চালিয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন; তাদের তালিকায় উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়াদের নাম নেই। ফলে বহিষ্কৃৃত এসব নেতাকে নিয়ে বিএনপির উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের নেতাদের তেমন আগ্রহ নেই এবং দলের সিদ্ধান্তে খুশি।

দেশে গণতন্ত্র নেই, ভোটের অধিকার নেই এ অবস্থায় রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ গণমাধ্যমের ভূমিকা কি? গণমাধ্যম কার্যত গত ১৫ বছর ‘রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ’ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজ্ঞানের বদৌলতে কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ নিজেদের মত প্রকাশ করছেন, তুলে ধরছেন। কিন্তু ওই সব মাধ্যমে খবর, মতামত, তথ্যে বস্তুনিষ্ঠতা থাকে না। সত্যের চেয়ে ভুল তথ্য, অর্ধসত্য তথ্য এবং অপ্রাসঙ্গিকতা বেশি ওই সব মাধ্যমে চর্চা হচ্ছে। ফলে মানুষের কাছে গণমাধ্যমের যে গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তা কমেনি বরং বেড়ে গেছে। কিন্তু কিছু কর্পোরেট হাউজ নিজেদের ব্যবসা এবং বৈধ-অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ সংরক্ষণে গণমাধ্যমকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করায় মিডিয়াগুলো প্রথমত ‘গণমাধ্যম’ চরিত্র হারাতে বসেছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্যবসার জন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে খবর প্রচার করে। কেউ কেউ নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধার্থে সরকারকে তোষামোদ করে খবর প্রচার ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রচার করছে। দ্বিতীয়ত, প্রশাসন ও রাষ্ট্্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করে যেনতেন ভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে বিজ্ঞাপন, আর্থিক সুবিধা, প্লট-ফ্লাট, সাংবাদিকদের বিদেশি মিশনে চাকরি ইত্যাদির মাধ্যমে মিডিয়ায়কে কাজে লাগানো হচ্ছে। এমনকি কিছু মিডিয়া মালিক ব্যবসায়ীদের মহাসম্মেলনে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আনার’ দৃঢ় অঙ্গিকার করে বক্তৃতা দিতে দেখা গেছে। এছাড়া ড. ইউনূসকে নিয়ে শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ দুই শতাধিক বিশ্ব নেতার ‘প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি’ দেয়ার পর অর্ধশত সম্পাদকের ওই বিশ্ব নেতাদের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ’ অভিযোগ তুলে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে সরকারের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। যা গণমাধ্যমের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। গত কয়েক বছরে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় বিপ্লব ঘটেছে। ব্যক্তি ও দলীয় লোক বিবেচনায় টিভি ও পত্রিকার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। যারা লাইসেন্স পেয়েছেন তারা সরকার বিপদে পড়ে এমন তথ্য পেলেও প্রচার না করে একদিকে উট পাখির মতো বালুতে মুখ লুকিয়ে রাখছেন; অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের অনুকম্পা পেতে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল নিয়ে সত্য-মিথ্যা ও অর্ধসত্য খবর প্রচার করছেন। ফলে গণমাধ্যম তার প্রকৃত চরিত্রে নেই। অন্যদিকে যে সব গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক সরকারের এসব বিষয় পাত্তা দেন না তারা নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। এটা ঠিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যে মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই; এবং শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমের ওপর মানুষকে ‘প্রকৃত সত্যতথ্যের’ জন্য নির্ভর করতে হয়। কিন্তু গণমাধ্যম সে ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

প্রশ্ন দীর্ঘ এই ১৭ থেকে ১৮ বছরে দেশের সবচেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে কী অর্জন করলো এবং তারা বিসর্জন দিলোই বা কী? বিদেশি ঋণে দৃশ্যমান ব্রিজ, ফ্লাইওভার, ট্যানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার সাফল্য দেখিয়েছে একটি দল। একই সঙ্গে বিদেশে টাকা পাচার, মন্ত্রী-এমপিদের বিদেশে বাড়ি, ব্যবসা, টাকার পাহাড় গড়া নিয়ে দুর্নাম কুড়িয়েছে। প্রশাসনকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী’ শব্দগুলোর অর্থ পাল্টে দিয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে জেলায় জেলায় সুপারস্টার নামের ‘মনস্টার’ ও মেগাস্টার ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইনের দানব’ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে নির্বাচনের নামে ‘পাতানো ভোট’ করে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এতে করে সময়ের প্রয়োজনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয়া ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের যে তৃণমূলে সাংগঠনিক কাঠামো ছিল তা ভেঙ্গে গেছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বদলে দলের কর্তৃত্ব চলে গেছে মনস্টারদের হাতে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির ভুমিকাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে রাজনৈতিক ইমেজ খুইয়েছে। পক্ষান্তরে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপি তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পেরেছে। বিএনপিকে বলা হতো সমর্থন নির্ভর দল। ক্ষমতার গর্ভে জন্ম নেয়ায় সারাদেশের গ্রাম পর্যায়ে দলটির তেমন গণভিত্তি ছিল না। কিন্তু গত ১৭ বছরের জুলুম-নির্যাতন, হামলা-মামলা নেতাদের কারাবরণ এবং প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নিষ্পেশনে মানুষের সহানুভূতি বেড়েছে। তৃণমূলে শক্তভীতি তৈরি হয়েছে। এমনকি দলটি ‘নির্বাচন বর্জন’ ঘোষণায় কয়েক কোটি ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাননি। দলটির নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে দোদুল্যমনতা থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে দলটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে নতুন প্রজম্মের কাছে বিএনপি এখন ‘রাজনৈতিক বিস্ময়’। কারণ শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থা দেখছে। একদিকে শোষণ, ক্ষমতার যাচ্ছেব্যবহার এবং প্রতিপক্ষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন, হামলা-মামলা। অন্যদিকে বিএনপির নেতাদের দুঃখকষ্ট ও দলের জন্য ত্যাগ-তিতীক্ষা, কারাবরণ। গত কয়েক বছর ধরে এ চিত্র নতুন প্রজন্ম নিজেদের মতো করেই বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। চোখ-কান খোলা রাখা নতুন প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুলিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে। অতপর দলটির নেতাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অবজ্ঞা, তুচ্ছজ্ঞান করে কথা বলা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ স্ববিরোধী এবং বিরোধীদের নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন। উত্থান ও পতন এটি জগতের নিয়ম। অথচ দলটির কেউ কেউ মনে করছেন তারাই সারাজীবন ক্ষমতায় থাকবেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫১ সালে জুলিয়াস সিজারের হাত ধরে রোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সে সম্রাজ্যের পতন হয়েছিল অটোমান তুর্কিদের হাতে ১৪৫৩ সালে। এ জগতে এমন একটি শক্তি নেই যার উত্থান হয়েছে কিন্তু পতন বা ধ্বংস হয়নি। বর্তমানে যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চার বার ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাসীন দলটি জিএম কাদেরের ‘ভাষায় রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে’। যারা যা বলছেন-করছেন তাতে পরিষ্কার তারাই সর্বেসর্বা, অন্য কেউ নেই। কিন্তু ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও প্রতিচ্ছবি কেমন হবে তা সত্যিই বলা কঠিন। কারণ একদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে দলটি যে ভাবে মনস্টার, ফ্রাঙ্কেস্টাইন তৈরি করেছেন। তারা এখনোই মূল নেতৃত্বের আদেশ-নির্দেশ মানছে না। অথচ মূল নেতৃত্ব ওই মনস্টারদের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে নতুন প্রজম্মের শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা যেভাবে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সামগ্রিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করছেন তাতে ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি কেমন হবে তা বলা সত্যিই দুষ্কর।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু